১০ পয়সার বিনিময়ে লালদিঘী বিক্রি!
- আপডেট সময় : ০১:১৫:৪৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২৭ বার পড়া হয়েছে
দিনটা আর অন্য দশ দিনের মত নয়। দেখা মিলেছে ইট পাথরের শহর ভেদ করে একটা সুন্দর সাজানো-গোছানো প্রকৃতির।বলছি চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী ‘লালদিঘী’র’ কথা।এখানে সকাল হলেই শুরু হয় পাখির কলকাকলি।আশপাশের গাছগুলো থেকে বেড়াতে বেড়িয়ে পড়ে একদল হরেক প্রজাতির পাখি।শুরু হয় মানুষের আনাগোনা। কেউ আসে হাঁটতে আবার কেউবা আসে এক চিলতে মন ভালো করে দেয়া সকালের প্রকৃতিটুকু দেখতে।কারণ শ্বাসরুদ্ধকর এ শহরে সবুজ কিংবা গ্রাম্য পুকুর বা দিঘী সবই আছে এখানে।উপভোগ করা যায় ছুটিয়ে।
নগরীর জেল রোডের শেষ সীমানায় অবস্থিত কোতোয়ালী থানাধীন ‘লালদিঘী’। ২.৭০ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই লালদীঘি। এই লালদিঘীকে কেন লালদিঘী বলা হয়? অনেকেই বলে থাকেন এই দিঘীর পানি লাল কিংবা এইখানে যা ছিলো সবই লাল।কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলে লালদিঘীর পাশে অবস্থিত লালঘর(চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার) ও লালকুঠি(চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ হেড কোয়ার্টাস) লাল পাগড়ি পরিহিত পাহাড়াদাররা পাহাড়া দিত বলেই এটি লালদিঘী। তাছাড়া এই দিঘীর মালিক রায় বাহাদুর রাজকুমার ঘোষের কণিষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রলাল ঘোষের পুত্র অমরজিৎ ঘোষের সাথে কথা বলে জানা গেলো এখানকার অর্থাৎ এই লালদিঘীর পানি ছিলো হালকা লালচে।
ঠিক যখন চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসনের সূচনা শুরু হয়, তখন এই পুকুরটিকে দীঘিতে পরিণত করা হয়, আর পাশে দুটো লালকুটি আর লালঘর অবস্থিত বলে এটির নাম হয় লালদিঘী।
বিকাল হলেই লালদিঘীতে নামে মানুষের ঢল। কেউ আসে অবসর যাপনে, কেউ আসে হাঁটতে ,আবার কেউ আসে সৌন্দর্য উপভোগ করতে।দিঘীর প্রবেশের পশ্চিম পাশের যে গেটটি রয়েছে সেটিতে ঢুকতেই চোখে পড়বে একটি সুসজ্জ্বিত বাগান। অবসর যাপনের জন্য এ যেন যথাযথ জায়গা।তার পাশেই রয়েছে লালদিঘী শাহী জামে মসজিদ।দিঘীর পশ্চিম পাড়ে ২ গম্বুজ বিশিষ্ট ৩ তলার এই মসজিদ খোলা থাকে সর্বসাধারণের জন্য। সাধারণ মানুষ,পথচারী ওয়াক্ত হলেই এখানে নামায আদায় করে।
আর বাগান পেরিয়ে ভেতরে গেলেই দেখা মিলবে লালদিঘী’র চারপাশে দলবেধেঁ হাটছে সাধারণ মানুষ।সাধারণ মানুষের জন্য এ দিঘী ভোর ৬ টা থেকে সকাল ৮ টা পর্যন্ত এবং এরপর বন্ধ হয়ে দুপুর ৩ টা থেকে রাত ৯ টা অবধি খোলা থাকে। মজার বিষয় হলো এখানে হাঁটার সময় যদি কেউ আহত কিংবা অসুস্থ হয় তাহলে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য দিঘীর একপাশে রয়েছে ভ্রাম্যমাণ ডাক্তার।ডায়বেটিকস পরীক্ষা, প্রেশার মাপা, ওজন মাপা সহ এরা দীর্ঘ ১ যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আসছে।
স্থানীয় প্রবীণ নিতাই সাহা বলেন, ৪ যুগেরও বেশি সময় ধরে এই লালদিঘীতেই অবসর কাটিয়েছি ।আমার শৈশবে আমরা সদলবলে এখানে আসতাম। তখন এতো মানুষ এখানে ছিলো না।জনমানবহীন পরে থাকতো এই দিঘী।আমরা কত দুষ্টুমি করেছি এ দিঘীতে।স্মৃতি মনে করলে আমার দু’চোখ এখনো ১৮ বছর বয়সে গিয়ে বসে! কি যে এক ভালো লাগা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। তবে লাল পাহাড়াদারদের আমি দেখেছি। তারা দেখাশুনার দায়িত্বে থাকতো।
স্থানীয় ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী বলেন, আমি চাই মানুষ সঠিক ইতিহাস জানুক। কারণ ইতিহাস মানুষকে সামগ্রিকভাবে সমৃদ্ধ করে। আমি ভেবেছি এই দিঘীতে প্রবেশের মুখে একটি বড় বিলবোর্ডে লাগিয়ে মানুষকে ইতিহাস জানার ব্যবস্থা করবো।
তিনি আরো বলেন, এই দিঘী মাত্র ১০ পয়সার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিলো। কালের বিবর্তনে সে ইতিহাস এখন ক’জনই বা জানে। তবে এটি(লালদিঘী) এখন দেখাশোনার দায়িত্বে আছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।আমি সবাইকে এ দিঘীর ব্যাপারে আরো যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানাই।
অন্যদিকে লালদিঘী’র মাঠকে আমরা(চট্টগ্রামের মানুষরা) সবচেয়ে বেশি চিনি জব্বারের ঐতিহাসিক বলিখেলা এখানে অনুষ্ঠিত হয় বলে। কিন্তু সেটি নামে লালদিঘী’র মাঠ হলেও মুসলিম হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি স্কুলের খেলাধূলার মাঠ হিসেবেই রয়েছে। কিন্তু সবাই এটিকে লালদিঘী মাঠ হিসেবেই চেনে। এখানে ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলাসহ রাজনৈতিক দলগুলোর বিশাল বিশাল সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া দেশের স্বাধীনতার বহু অগ্রগামী ভাষণের সূচনা এই লালদিঘী’র মাঠ থেকেই দেয়া হয়েছিলো।
সন্ধ্যা হলেই মানুষ দিঘীকে বিদায় জানায়।ঠিক তার আগ মুহূর্তে দিঘীর পানিগুলো কেমন জানি কালো হয়ে যায়। ঠিক যেমন কন্যা সন্তানের বিয়েতে বাপের বাড়ি জুড়ে নেমে আসে হাহাকার।তখন দিঘী’রও যে মন খারাপ হয় তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
সবশেষ আমরা কথা বলেছিলাম রায় বাহাদুর রাজকুমার ঘোষের কণিষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রলাল ঘোষের পুত্র অমরজিৎ ঘোষের সাথে।
তিনি বলেন, আমরা শৈশবে এখানে রোজ এসেছি। এখানকার পানি যে লাল ছিল সেটি আমার এখনো স্পষ্ঠ মনে পড়ে। শুধু তাই নয় এখানে এক ধরণের লাল রংয়ের মাছ ও ছিলো।তাছাড়া আমার বাবা,জেঠা সবার নামের শেষেও এই লাল শব্দটা জুড়ে আছে।
লালদিঘী সম্পর্কে তিনি এবার বলেন, আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন অত্যন্ত দানশীল একজন মানুষ।একদিন ঠাকুরদা’কে তার বন্ধুরা বলছিলো চট্টগ্রামের মানুষের নাকি কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই( বিনোদনের জন্য)! তারা বলছিলো ঠাকুর’দা যেন এই পার্কটিকে সাধারণের মানুষের জন্য দান করে দেই। যে কথা সে কাজ। আমার ঠাকুর’দাও প্রভাবিত হয়ে এটি দান করে দিয়েছিলেন।সে থেকে এটি এখনো সর্বসাধারণের জন্য বিনা পয়সায় উন্মুক্ত।